সুন্দরবনের ক্যানিং মহকুমা জুড়ে পালিত হল হুল দিবস

সুন্দরবনের ক্যানিং মহকুমা জুড়ে  পালিত হল হুল দিবস 


ক্যানিং| স্বাধীনতাসংগ্রামের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিবস, যা ঐতিহাসিক সাঁওতাল হুল দিবস বা সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস নামে পরিচিত। মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের শোষণ-নিপীড়ন এবং ব্রিটিশ পুলিশ-দারোগাদের অত্যাচারে নিষ্পেষিত সাঁওতাল জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে ১৮৫৫ সালে সিধু মুরমু ও কানু মুরমু এবং দুই ভাই চান্দ ও ভাইরো ভারতের নিজ গ্রাম ভগনাডিহতে এক বিশাল সমাবেশের ডাক দিয়েছিলেন। সাঁওতাল জনগণ মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের নিপীড়নে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল সে সময়। মহাজনের ঋণের ফাঁদে পড়তে হতো বংশপরম্পরায়। স্ত্রী-পুত্ররা মহাজনের সম্পত্তি হয়ে পড়ত। পুলিশের সহায়তায় তাদের গবাদিপশু ও জমি কেড়ে নেওয়া হতো। প্রতিবাদ করলে পাল্টা গ্রেপ্তারের শিকার হতো; এমনকি সে সময় ব্রিটিশ সরকারের উল্টো খড়্গ নেমে আসত তাদের ওপর।
১৮৫৫ সালেই যে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা তা নয়, এর আরও ৭৫ বছর আগে ১৭৮০ সালে সাঁওতাল জননেতা তিলকা মুরমুর (যিনি তিলকা মাঞ্জহী নামে পরিচিত) নেতৃত্বে শোষকদের বিরুদ্ধে সাঁওতাল গণসংগ্রামের সূচনা হয়। তিনি সর্বপ্রথম সাঁওতাল মুক্তিবাহিনী গঠনের মাধ্যমে পাঁচ বছর ধরে ইংরেজ শাষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালান। ১৭৮৪ সালের ১৭ জানুয়ারি তাঁর তিরের আঘাতেই ভাগলপুরের ক্লিভল্যান্ড প্রাণ হারান। ১৭৮৫ সালে তিলকা মাঞ্জহী ধরা পড়েন এবং তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮১১ সালে বিভিন্ন সাঁওতাল নেতার নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। এরপর ১৮২০ সালে তৃতীয়বার এবং ১৮৩১ সালে চতুর্থবার সাঁওতাল গণসংগ্রাম গড়ে ওঠে।
অবশেষে শোষণহীন স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন ৩০ হাজারেরও অধিক সাঁওতালকে নিয়ে সমাবেশ এবং কলকাতা অভিমুখে প্রথম গণযাত্রা করেন বীর সিধু-কানুরা। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্য মিছিল বা গণযাত্রার সূচনা এটাই প্রথম; যার ধারাবাহিকতায় আজও উপমহাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মিছিল-লংমার্চ করে আসছে। পদযাত্রার সময় অত্যাচারী মহাজন কেনারাম ভগত ও জঙ্গিপুরের দারোগা মহেশাল দত্ত ছয়-সাতজন সাঁওতাল নেতাকে বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার করেন। সিধু ও কানুকে গ্রেপ্তার করতে উদ্যত হলে বিক্ষুব্ধ সাঁওতাল বিপ্লবীরা ৭ জুলাই পাঁচকাঠিয়া নামক স্থানে মহাজন কেনারাম ভগত, মহেশাল দত্তসহ তাঁদের দলের ১৯ জনকে হত্যা করে এবং সেখানেই সাঁওতাল বিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলিত হয়। এরপর টানা আট মাস ধরে চলে সাঁওতাল বিদ্রোহ। ২১ জুলাই কাতনা গ্রামে ইংরেজ বাহিনী বিপ্লবীদের কাছে পরাজয় স্বীকার করে। জুলাই মাসেই বীরভূমের বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র নাগপুর বাজার ধ্বংস করে বিপ্লবীরা, যেখানে সাঁওতাল জনগণকে ন্যায্যমূল্যে মালামাল দেওয়ার পরিবর্তে অত্যাচার করা হতো। ৩০ জুলাই লেফটেন্যান্ট রুবি কর্তৃক মুনহান ও মুনকাতারা গ্রাম ধ্বংস করা হলে পরে ১৭ আগস্ট ইংরেজ সরকার কর্তৃক আত্মসমর্পণের ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয় এবং সাঁওতালরা তা প্রত্যাখ্যান করে। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিধু-কানুর বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকার ‘অস্বা সামরিক আইন’ (অস্ত্রশস্ত্র বহনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা) জারি করে। ইংরেজ সরকার সামরিক আইন জারি করলেও বিপ্লবের মুখে ১৮৫৬ সালের ৩ জানুয়ারি সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেয়। আট মাসব্যাপী বিদ্রোহের শেষ পর্যায়ে লেফটেন্যান্ট ফেগানের পরিচালিত ভাগলপুরে হিল রেঞ্জার্স বাহিনীর হাতে সাঁওতালদের পরাজয় ঘটে। সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতৃত্ব যে শুধুই সিধু-কানু বা চান্দ-ভাইরোরা দিয়েছেন তা নয়, তাঁদের সঙ্গে সাঁওতাল নারীদের নিয়ে বিপ্লব করেছিলেন দুই বোন ফুলো মুরমু ও ঝানো মুরমু। ব্রিটিশ সেপাইরা ফুলো মুরমুকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করে তাঁর লাশ রেললাইনে ফেলে রেখে যায়। ইতিহাসের প্রথম বীরাঙ্গনা হিসেবে সাঁওতাল জাতিসত্তা তাঁকে আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। অবশেষে ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইয়ে সিধু নিহত হন এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে কানুকে ফাঁসি দেওয়া হয়।প্রতিবছর ৩০শে জুন পালিত হয় হুল দিবস।তাদেরই স্মরনে প্রতিবছর পালিত হয় হুল দিবস।আর এই এদিন শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং-১ বিডিও অফিস ভবনে জেলা আদিবাসী উন্নয়ন বিভাগের আয়োজনে এবং জেলা তথ্য সংস্কৃতি দফতরের উদ্যোগে যথাযথ ভাবে পালিত হল হুল দিবস।এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত  জেলা শাসক উন্নয়ন সাগর চক্রবর্তী, জেলা তথ্য সংস্কৃতি দফতরের আধিকারিক লিপিকা বন্দ্যোপাধ্যায়,ক্যানিং পশ্চিম কেন্দ্রের বিধায়ক শ্যামল মণ্ডল, জেলা পরিষদের সহ সভাধিপতি শৈবাল লাহিড়ী,ক্যানিং-১বিডিও নীলাদ্রি শেখর দে,ক্যানিং মহকুমা তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের আধিকারিক সিধার্থ চক্রবর্তী প্রমূখ।এ দিন সুন্দরবনের আদিবাসী সম্প্রদায় তারা তাদের কৃষ্টি সংস্কৃতি তুলে ধরেন।টুসু গান,ঝুমুর নৃত্য পরিবেশন করেন তারা।এদিনের অনুষ্ঠানে জেলা পরিষদের সহ সভাধিপতি শৈবাল লাহিড়ী বলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে রাজ্য জুড়ে উন্নয়নের কর্মযঞ্জ চলছে।পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে।এই জেলায় প্রায় ১.৭ শতাংশ আদিবাসী সম্প্রদায় মানুষের বসবাস।আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় রাস্তাঘাট,পানীয় জল,কালভাট প্রমূখ উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে।তিনি আরও বলেন আদিবাসী সম্প্রদায় মানুষকে সন্মান দেবো বাচাঁর পথ দেবো।বি পি এল ভুক্ত যাদের তালিকা নাম আছে তাদের ৬০ বছর পূর্ণ হয়েছে গোল্ডেন পেসারে পেনশন পাবে।এদিন তিনি হুল দিবস বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাতও করেন।ক্যানিং পশ্চিম কেন্দ্রের বিধায়ক শ্যামল মণ্ডল বলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী উদ্যোগে শুধু এই জেলা নয় বাংলা জুড়ে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে আদিবাসী সম্প্রদায় মানুষের সামাজিক অর্থনৈতিক এবং সার্বিক উন্নয়নমূলক  কাজ করে চলেছে।সুন্দরবন জুড়ে তথা সারা বাংলায় যথাযথ ভাবে পালিত হচ্ছে  হুল দিবস।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন