সোমেন দেবনাথের বিদেশ থেকে পাঠানো লক্ষাধিক টাকার উপহার চুরি হয়ে গেল

সোমেন দেবনাথের বিদেশ থেকে পাঠানো লক্ষাধিক টাকার উপহার চুরি হয়ে গেল


  প্রশান্ত সরকার , বাসন্তী  

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার প্রত্যন্ত সুন্দরবনের বাসন্তীর বাসিন্দা সোমেন দেবনাথ গত ২০০৪ সাল থেকে বিদেশে মাটিতে ভ্রমণ করছেন দুই চাকার সাইকেলে করে ।  সোমেন দেবনা্থের  এই ভ্রমণের পেছনে একটি কারণ আছে। তিনি ছোটবেলায় একটি খবরের কাগজ থেকে জানতে পারেন – যে মানুষের শরীরে ক্যান্সারের থেকেও মারন রোগ এইচআইভি। কারণ তিনি ঐ খবরের কাগজে পড়েছিলেন কলকাতা মেডিকেল কলেজের সামনে একটি অসহায় মানুষকে পড়ে থাকতেন । সেই অসহায় মানুষটি পরিবারের মানুষজন বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে । কারণ ওই ব্যক্তিটি এইচআইভি আক্রান্ত হয়েছেন বলে। অবহেলায় রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে থাকতে একটা সময় ওই মানুষটির মৃত্যু ঘটে । এই ঘটনা খবরের কাগজে পড়ার পর সোমেন দেবনাথ নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেননি। তিনি বুঝেছিলেন এই রোগের হাত থেকে মানুষের কে সচেতন করতে হবে । মানুষের যথেষ্ট সচেতনতা অভাব আছে । কিন্তু সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে থাকা এই ছেলেটি কিভাবে সচেতন করবেন ? কে বা তার কথা শুনবে ? নানান  চিন্তা ভাবনা করে তিনি উপায় খুজে বার করেন ।


বছর খানেকের মধ্যে রাজ্য সরকারের এইডস্ ট্রেনিং সংস্থা, ওয়েস্ট বেঙ্গল সোসাইটি ফর এইডস্ কন্ট্রোল থেকে প্রশিক্ষণ নেন। তারপর নিজের গ্রামের স্কুলে এই রোগের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ক্যাম্পেইনিং শুরু করেন। এরপর প্রত্যন্ত সুন্দরবনের বাসন্তীতে নিজের গ্রামের মানুষকে এইডস্ নিয়ে সচেতনতার করে তোলেন। এরপর স্কুল শেষ করে কলেজ সেখানেও চলে একই কাজ। গ্রামের মানুষের মধ্যে এভাবে তার সচেতন বার্তা পৌঁছে দিতে থাকে ।এভাবে ২০০৪ সালে একদিন তিনি তার স্কুলে যাওয়ার সাইকেলটি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন । ভারতবর্ষে ২৮ টি রাজ্যে সাইকেলে চেপে তিনি এইচ আই ভি এডসের সচেতন করেন । এরপর তিনি আর বাড়ির দিকে ফিরে আসেন নি । সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বিদেশের মাটিতে। ২০০৪ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত তিনি সাইকেল চালিয়ে ১৮৪ টি দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছেন ।এবং তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন এডস এর মতন মারণ ব্যাধির সচেতন বার্তা । চলার পথে তার বিভিন্ন সময় ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে দিন কেটেছে সোমেনের । কখনো অনাহারে রাস্তার পাশে শুয়ে রাত কেটেছে। কখনো খোলা আকাশের নিচে আশ্রয়হীন হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রাত কেটেছে । কখনো আবার বিদেশের মাটিতে অজস্র মানুষের ভালোবাসা কুড়িয়েছেন । বিদেশের মাটিতে স্কুল ,কলেজ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের  সদস্যদের সাথে তিনি মিলিত হয়েছেন। এছাড়াও তার চলার পথে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে তিনি সাক্ষাৎ হয়েছে । তার মলিন ভাষা এবং ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে বিদেশের মানুষের সাথে ভাব বিনিময় করে গড়ে তুলেছেন সুসম্পর্ক। এছাড়াও বিদেশের মাটিতে গড়ে উঠেছে তার একাধিক বন্ধুত্ব যে বন্ধুরা তার পাশে থেকেছেন এবং প্রেরণা  জুগিয়েছেন তার চলার পথে ।  তিনি প্রতিটি দেশে একটি করে গাছ রোপন করেছেন যেটি তার স্মৃতি হিসেবে ওই দেশের মাটিতে থেকে যাবে । তবে বিভিন্ন দেশের মানুষের থেকে যেমন ভালোবাসা পেয়েছেন তেমন ভালোবাসার সাথে বিদেশের মানুষ তাকে কিছু উপহারও দিয়েছিলেন । তবে তিনি যেহেতু সাইকেল চেপে ভ্রমণ করছেন পৃথিবী তাই উপহারগুলো সাথে নিয়ে সাইকেল চালানো কখনোই সম্ভব নয় । তিনি বিদেশের মাটি থেকে কোন উপহার পেলে তিনি ওই স্থান থেকে কুরিয়ার করে ভারতে পৌঁছে দিতেন।

বর্তমানে সোমেন দেবনাথের মা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বারাুইপুর এলাকার সুভাষগ্রামে থাকেন । সুভাষগ্রামে  পিপল হাউস নামে একটি ভবন তৈরি করেছেন । যে ভবনে পথ চলতি অসহায় মানুষ রাতে আশ্রয় নিতেন । গ্রামের মানুষ শহরে ডাক্তার দেখানো সময় শহরে থাকার জায়গা না পেলে অথবা অনেক পরিযায়ী  শ্রমিক গ্রাম থেকে খুব সকালে অথবা ভোর রাতে ট্রেন ধরার জন্য এই ভবনে রাতে বিশ্রাম নিতে পারতেন । পিপল হাউস টি সোমেন দেবনাথের মা দেখাশোনা করতেন । সোমেন দেবনাথ বিদেশের মাটিতে যে যন্ত্রনা কষ্ট অনুভব করছেন সেই যন্ত্রনা যাতে দেশের মানুষ , নিজের এলাকার মানুষ না পায় সেই কথা ভেবে সুভাষগ্রামে পিপল হাউস তৈরি করতে মাকে বলেছিলেন ।


সোমেন দেবনাথ  বিদেশের মাটি থেকে উপহার গুলো পেতেন সেই উপহার পিপল হাউসের একটি ঘরে গুছিয়ে রাখতে সোমেন দেবনাথের মা । দুঃখের বিষয় পিপল হাউসে থাকা বিদেশের  মাটি থেকে পাওয়া মূল্যবান উপহার গু্লো  গত ৩০ শে সেপ্টেম্বর রাতে কে বা কারা ঘরের তালা ভেঙে চুরি করে নিয়ে গেছে। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছে । কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো রকম ভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করা বা উপহার উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি । ইতিমধ্যে পুলিশ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন । 

যে মানুষটি সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে এত কষ্ট করে সাইকেল চালিয়ে সচেতন বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন আর তার কিছু উপহার এইভাবে চুরি হয়ে যাবে সেটা কখনো ভাবতেই পারেনি সোমেন  দেবনাথের শুভাকাঙ্ক্ষীরা । সোমেন দেবনাথ জানিয়েছেন এই ঘটনাটি তার কাছে খুব বেদনা দায়ক কারণ প্রত্যেকটি উপহারের সাথে একটি করে আলাদা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যে স্মৃতি তিনি এত বছর ধরে কঠিন পরিশ্রম করে অর্জন করেছেন । 



সৌমেন দেবনাথ আগামী ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখে ভারতে ফিরে আসবেন । এখনো.৭ টি দেশে সাইকেল ভ্রমণ বাকি আছে। তিনি দেশে ফিরে সমাজে অবহেলিত এবং পিছিয়ে পড়া মানুষদের নিয়ে উন্নয়নের কাজ করবেন। এর ফলে গ্রামের অনেক অসহায় মানুষ ও উপকৃত হবেন । 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন